ঢাকা,বুধবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৪

সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বাঁচার উপায়

পুলিশ পরিদর্শক মো. সালাহউদ্দিন. পুলিশ পরিদর্শক মো. সালাহউদ্দিন। ফাইল ছবি

মো. সালাহউদ্দিন ::

দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে ঈদুল-আজহার আগে এবং পরে সড়ক দুর্ঘটনায় ২২৪ জন নিহত হয়েছেন। মারাত্মক আহত হয়েছেন ৯০৮ জন লোক।

এভাবে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো না কোনো তাজা প্রাণ ঝরে যাচ্ছে। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ সব দুর্ঘটনার ফলে থমকে যাচ্ছে বহু পরিবার।

সড়ক দুর্ঘটনায় যারা মারা যাচ্ছেন এবং যারা আহত হয়ে পঙ্গুত্ব জীবনযাপন করছেন একমাত্র তারাই এর কঠিন যন্ত্রণা এবং বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন।

এই কঠিন বাস্তবতা আপনার-আমার জীবনে যে কোনো সময় ঘটতে পারে। অতীতে আমরা বহু ইন্টেলেকচ্যুয়াল ব্যক্তিত্বদের হারিয়েছি।

এখন প্রশ্ন হল কেন এত দুর্ঘটনা? এর থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ নেই?

কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই বলা হয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অথবা ফিটনেস না থাকার কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে।

আমার পর্যবেক্ষণের আলোকে বলতে পারি, শুধু চালকদের বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো এবং রোড সাইন না বুঝে যেখানে-সেখানে ওভারটেক করার কারণে ঘটছে এ সব মারাত্মক দুর্ঘটনা।

সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণ রয়েছে। এ সব কারণ সম্পর্কে আমরা প্রায় সবাই অবগত আছি। তবে দুর্ঘটনার জন্য মূল ভূমিকা পালন করেন চালক নিজে।

ত্রুটিপূর্ণ গাড়ির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে সেটাও আমি চালককে দায়ী করব। কারণ গাড়ি বের করার পূর্বে গাড়ির চাকা থেকে শুরু করে সবকিছু চেক করার দায়িত্ব চালকের। বর্তমান বেশি দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন বাস চালকেরা।

একজন চালককে বুঝতে হবে তার ওপর নির্ভর করছে উক্ত গাড়ির সমস্ত যাত্রীর জীবন এবং তাদের পরিবারের জীবন। তার একটা ভুলের কারণে যে কোনো পরিবারে আসতে পারে ভয়াবহ পরিস্থিতি।

সড়ক দুর্ঘটনার জন্য গাড়ির মালিক অনেকাংশে দায়ী কারণ অনেক মালিক গাড়ি মেরামত না করে ত্রুটিপূর্ণ গাড়ি চালাতে চালককে বাধ্য করেন। একজন চালক একটানা ৬ ঘণ্টা গাড়ি চলনার কথা অথচ মালিকরা তাদের দিয়ে প্রায় ১৩/১৪ ঘণ্টা গাড়ি চালাচ্ছেন।

বিশেষ করে সকালের দিকে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটে সেটা ঘুমের কারণে ঘটে। গাড়ি চালানো অত্যধিক পরিশ্রমের কাজ যে কোনো সময় ঘুম চলে আসতে পারে। তাই মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন যদি বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করত তাহলে এ সব দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হতো।

অনেক যাত্রী চালকদের দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাতে উৎসাহিত করেন। এটা পরিহার করতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশ অধিক জনসংখ্যার দেশ। তাই মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ গাড়িগুলো সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও পুলিশের তৎপরতার কারণে অনেক এলাকার মহাসড়কে নিষিদ্ধ গাড়িগুলো বন্ধ আছে।

যেহেতু মহাসড়কের সমস্যাগুলো স্বল্প সময়ে সমাধান করা সম্ভব নয়, তাই আমাদের গাড়ির গতি কমাতে হবে। বাস এবং ট্রাকের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গতি ৭০ কিলোমিটারের ওপরে হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।

বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে মহাসড়কের বাঁকে। বাঁক এলাকায় রাস্তার মাঝখান দিয়ে সাদা লম্বা দাগ দেয়া থাকে। এই সমস্ত জায়গায় ওভারটেক করা নিষেধ। আমাদের দেশের বেশিরভাগ চালকদের রোড সাইন না বুঝে ওভারটেক করার চেষ্টা করে ফলে ঘটে যায় মারাত্মক দুর্ঘটনা।

ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়ার পূর্বে চালকদের রোড সাইন, গাড়ির হেডলাইটের সঠিক ব্যবহার এবং ট্রাফিক আইনের বেসিক বিষয়গুলোর উপর প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি।

বর্তমান অধিক সি সি যুক্ত বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে বহু প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল কেনার ক্ষেত্রে মা-বাবা সতর্ক থাকলে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব।

মহাসড়কের এ দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সারা দেশে স্পিড গানের ব্যবহার নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রতি জেলায় যদি গাড়িসহ দুটি টিম নিয়োগ করা যায় এবং প্রতিটি টিমকে কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার এলাকা নির্ধারণ করে দিয়ে স্থান পরিবর্তন করে স্পিড গানের মাধ্যমে গাড়ির গতি শনাক্ত করে যদি দ্রুতগতির গাড়ির বিরুদ্ধে মামলার জরিমানা করা অব্যাহত থাকে তাহলে মহাসড়কে চালকরা দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে সাহস পাবেন না।

গাড়ির গতি শনাক্ত করার জন্য একজন পুলিশ সদস্য স্পিডগান এবং walkie-talkieসহ কোনো গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দ্রুতগতির গাড়িগুলো শনাক্ত করে নির্ধারিত ৫০০ মিটার দূরে অবস্থানরত টিমকে কত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে তা অবহিত করে যদি ওইসব গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। এই ক্ষেত্রে জরিমানা মালিকের পরিবর্তে চালককে বহন করতে হয় তাহলে পরবর্তীকালে চালক দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকবেন।

এই পদ্ধতিতে স্বচ্ছতার মাধ্যমে কাজ করার জন্য পুলিশ সুপার কর্তৃক বাছাইকৃত সৎ এবং পজিটিভ মনের অধিকারী পুলিশ সদস্যদের নিয়োগ করা গেলে এবং এর সঙ্গে যদি প্রতিটি টিমে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা যায় এবং দুই ঘণ্টা অন্তর অন্তর জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার মহোদয় নির্দেশনামূলক পরামর্শ দেন তাহলে উক্ত টিম কাজ করতে উৎসাহিত হবে।

এ ছাড়া এ টিম মহাসড়কে নসিমন, করিমন এবং ইজিবাইকসহ মহাসড়কে নিষিদ্ধ গাড়ির বিরুদ্ধে জরিমানা করে মহাসড়ক নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে।

স্পিড গানের ব্যবহার যদি সারা দেশে মহাসড়কে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্থান পরিবর্তন করে ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক নগদ জরিমানা করা অব্যাহত থাকে তাহলে আমার বিশ্বাস সারা দেশের মহাসড়ক ৭ দিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ আসতে বাধ্য। একই সঙ্গে জাতি এই অভিশপ্ত দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পাবে।

আমার অভিমত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দ্রুতগতির গাড়ির বিরুদ্ধে যে নগদ জরিমানা করা হবে তার শতকরা ৫০ ভাগ টাকা ম্যাজিস্ট্রেটসহ উক্ত টিমকে ইন্সেন্টিভ হিসেবে দেয়া হলে এবং অবশিষ্ট ৫০ ভাগ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা করলে উক্ত কাজ করতে তারা উৎসাহিত হবেন।

লেখক: পুলিশ পরিদর্শক, শহর ও যানবাহন, ঝিনাইদহ।

ইমেইল: [email protected]

পাঠকের মতামত: